বর্ণাঢ্য জীবন

জন্ম

১৯৫৭ সালের ৩ ডিসেম্বর। নবান্নের উৎসবে, আমন ধানের পাকা ঘ্রাণে মোহিত সুগন্ধি গ্রাম। খুলনার বর্তমান দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটিতে অবস্থিত সেই সুগন্ধি গ্রামে অগ্রহায়নের মিষ্টি সকালে রত্নগর্ভা মা মন্নুজান নেসা’র কোল জুড়ে ভুমিষ্ঠ হন ক্ষণজন্মা মহান পুরুষ শেখ বেলাল উদ্দিন। পিতা মোদাচ্ছের আলী’র শ্বশুরালয় এই সুগন্ধি গ্রাম। জন্মের সময় মোদাচ্ছের আলী তার নিজ বাড়ি খুলনার রায়েরমহলে অবস্থান করছিলেন। ২-৩ দিন পর সংবাদ পান তিনি। সংবাদ পাওয়ার পর পিতা মোদচ্ছের আলী তাঁর স্ত্রী মন্নুজান নেসা ও প্রথম সন্তান শেখ বেলাল উদ্দিনকে নিয়ে আসেন খুলনার রায়েরমহল এলাকায় তাঁর পিত্রালয় আল্লাহর দান মঞ্জিলে। তখনও রায়েরমহল নিভৃত গ্রাম। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। পিতা মোদাচ্ছের আলী আদালতের মহুরী থাকার কারণে সবার কাছে সমাদৃত ছিলেন সৎ চরিত্র ও শান্ত মনের মানুষ হিসেবে। প্রথম সন্তান হিসেবে বেলাল এর আগমন তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গ্রামের সকল শ্রেনী পেশার মানুষের কাছে একটি উৎসব ও আনন্দের উপলক্ষ হয়ে ওঠে।


শিক্ষাজীবন

শৈশব থেকেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী শেখ বেলালের লেখাপড়া শুরু হয় তাঁর জন্মস্থান রায়েরমহল এর ঐতিহ্যবাহী স্কুল ‘রায়েরমহল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ থেকে। সেখানেই শেখ বেলালের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয়। প্রাথমিক শিক্ষার সময়কালে তার শিক্ষাগুরু এরশাদ আলী’র কাছে সামাজিক, ধর্মীয়, নৈতিক শিক্ষাসহ সববিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে থাকেন শেখ বেলাল উদ্দিন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ভর্তি হন তৎকালীন খুলনার সবচেয়ে প্রথিতযশা বিদ্যাপীঠ ‘খুলনা জেলা স্কুলে’। ১৯৭২ সালে জেলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম শ্রেণীতে মেট্রিকুলেশন (এসএসসি) পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনার জন্য শেখ বেলাল ভর্তি হন খুলনার দৌলতপুরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী ডে-নাইট কলেজে। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯৮৪ সালে শেখ বেলাল কৃতিত্বের সাথে ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) পাস করেন। তৎকালীন সময়ে দক্ষিনাঞ্চলে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট নিয়ে জ্ঞানের আলো বিকীরণ করতো। একটি হচ্ছে খুলনার বিএল (ব্রজলাল) কলেজ আরেকটি বরিশালের বিএম (ব্রজমোহন) কলেজ। খুলনার বিএল কলেজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিলো। পরবর্তীতে এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যায়। শেখ বেলাল বিএল কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স পাস করেন। ওই সময়েই তিনি ছাত্ররাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব প্রদান করেন শেখ বেলাল। সেই সাথে সমাজ গঠনে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন তিনি। শৈশব থেকেই লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রতি ঝোঁক ছিলো শেখ বেলালের। ছাত্রজীবনে তিনি যুক্ত হন জাতীয় শিশু সংগঠন ফুলকুঁড়ি আসরে। এছাড়া সমসাময়িক বিভিন্ন স্থানীয় ম্যাগাজিন, প্রত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে।


কর্মজীবন

ছাত্রজীবন শেষ করে শেখ বেলাল উদ্দিন প্রভাষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন খুলনা ইসলামিয়া কলেজে। পরবর্তীতে একটি জাতীয় দৈনিকের খুলনা’র ব্যুরো চীফ হিসেবে যোগদান করে তার পছন্দের পেশাটি বেছে নেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমাজকর্মে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন।


পারিবারিক জীবন

শেখ বেলাল উদ্দিন নয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। বিয়ে করেছিলেন খুলনার গোয়ালখালী এলাকার তানজিলা খাতুনকে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তার মৃত্যুর পর তানজিলা খাতুন অন্যত্র বিয়ে করেন। তাঁর নিজের সন্তান না থাকার কারণে অন্য ভাইবোনদের সন্তানদের তিনি নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসা ও স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন। তাঁর অন্য ৮ ভাইবোনের পরিবারের প্রধান পরামর্শক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন আমৃত্যু। শেখ বেলাল উদ্দিনের আদরের ভাগ্নে-ভাগ্নীদের সাথে সময় কাটাতেন অবসয় সময়ে। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন সহ বিভিন্ন খেলার সাথী হতেন তাদের। তাঁর বেশি ভাইবোন হবার কারণে আত্মীয়স্বজনদের বিস্তৃতি পুরো বাংলাদেশ জুড়ে ছিলো। তাঁর ভগ্নিপতিরা বেশিভাগই থাকতেন খুলনার বাইরে। তাই প্রয়োজনের তাগিদে পারিবারিক বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিতে ছুটে যেতেন ঢাকা, রাজশাহী সহ দেশের অন্যান্য স্থানে।


সমাজকর্ম ও বিভিন্ন সংগঠনের সাখে সম্পৃক্ততা

শেখ বেলাল জাতীয় শিশু সংগঠন ফুলঁকুড়ি আসরের খুলনা মহানগরী শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি খুলনা সংস্কৃতি কেন্দ্রের সভাপতি ছিলেন। একাধিকবার খুলনা প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপালন করেন তিনি। সাংবাদিকদের সংগঠন মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন (এমইউজে) খুলনার পর্যায়ক্রমে সহ-সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ বেলাল উদ্দিন। সাংবাদিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে শেষ বেলাল আমৃত্যু কাজ করেছেন। হলুদ সাংবাদিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দিখেয়ে বিরাগভাজন হয়েছেন দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। সাংবাদিকদের আপদকালীন সময়ে অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে এসেছেন শেখ বেলাল। বিভিন্ন সময়ে আপোষহীন ও স্পর্শকাতর সংবাদ প্রকাশে হুমকী’র সম্মুখীনও হয়েছেন শেখ বেলাল উদ্দিন।


মৃত্যু

২০০৫ সালের ৫ ফ্রেবুয়ারী। প্রতিদিনের মতো মাগরিব নামাজ শেষে তাঁর প্রিয় সময় কাটানোর জায়গা খুলনা প্রেসক্লাবের সামনের চত্বরে প্রবেশ করেছেন ১২৫ সিসি’র ইয়ামাহা ওয়াইবিএক্স বাইকটি নিয়ে। স্টার্ট বন্ধ করে চাবিটি নিয়ে নামছেন। মুহুর্তেই থেকে নামছেন ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। রিমোট কন্ট্রোল বোমা দিয়ে তাঁর বাইকের পেট্রোল ট্যাংক ব্লাস্ট করানো হয়। ট্যাংক থেকে পেট্রোল ছিটে তাঁর শরীরে লাগে ও আগুন ধরে যায়। শেখ বেলাল ওই অবস্থায় রাস্তার পাশে রাখা বালি’র ঢিবিতে আগুন নেভাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এরমধ্যেই তার শরীরের উপরিভাগের আশি শতাংশ দগ্ধ হয়ে যায়। সাথে সাথে তাঁকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। গুরুতর অবস্থার কারণে পরদিন সামরিক বাহিনী’র হেলিকপ্টারে করে শেখ বেলালকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল - সিএমএইচ এ। দীর্ঘ ৫ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ১১ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় শেখ বেলাল উদ্দিন শহীদ হন। পরদিন সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে তাঁকে খুলনায় আনা হয়। তৎকালীন শিল্পমন্ত্রি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রি, স্থানীয় সংসদ সদস্য সহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের অগনিত মানুষ খুলনা সার্কিট হাউস মাঠে তার জানাজায় অংশ নেন। জানাজা শেষে আল্লাহ’র দান মঞ্জিলের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন অন্যায়ের সাথে আপোষহীন শহীদ সাংবাদিক শেখ বেলাল উদ্দিন।